নিজস্ব প্রতিবেদক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইছে নারায়নগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে। এখানে বিএনপির মনোনয়ন পেতে এ পর্যন্ত ৬ জন হেভিওয়েট নেতার দৌড়ঝাঁপ আর দলীয় কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন,এনসিপিসহ অন্যান্য দলগুলো এগুচ্ছে কৌশলী পন্থায়। তবে গণঅধিকার পরিষদ,আমজনগণ, হেফাজতে ইসলামসহ অন্যদের মৃদু অবস্থান দেখা গেছে।
স্থানীয় নেতা কর্মী ও ভোটারসহ সাধারণ নাগরিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ ১ আসনে বিএনপির ৬ নেতা তাদের মনোনয়ন পেতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে উঠান বৈঠক, সভা-সমাবেশ ও গনসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচি ও জাতীয় অনুষ্ঠানে সমর্থকদের উপস্থিতি বাড়াতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছেন। প্রায় চার লক্ষাধিক ভোটার আর ১০ লাখ বাসিন্দার জনপদ নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে রূপগঞ্জের নির্বাচনি আসনে রয়েছে ছোট মাঝারি বড় কয়েক হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখানে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মাদক, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজির দৌড়াত্ম্য। সবচেয়ে বড় সংকট আবাসন কোম্পানির বালি ফেলে ভূমিদস্যুতায় লিপ্ত হওয়া। তাই প্রার্থীরা ভোটারদের মন জয় করলে এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েই ভোটের মাঠে এগুচ্ছেন।
অতীত রাজনৈতিক ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসলেও এবার তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
সূত্রমতে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য মরহুম আব্দুল মতিন চৌধুরী ১৯৭৯ সালে প্রথম এবং পরে ১৯৯১ সালে রূপগঞ্জ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ জয়লাভ করেন। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার আব্দুল মতিন চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতিক ২০০৮ থেকে পরবর্তী চারবার এখানে নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন।
যদিও ভোটের মাঠ গোঁছাতে কাজ করছেন ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন,জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী, এনসিপিসহ দলগুলো। এদিকে এককভাবে বর্তমানে দলের মনোনয়ন নিয়ে বিএনপিতে বিভাজন স্পষ্ট হলেও প্রার্থী চূড়ান্ত হলে সবাই মিলে মাঠে একত্রিত হয়ে কাজ করবে বলে মনে করছে দলের নেতাকর্মীরা।
এ আসনে সংসদীয় আসনে বিএনপি থেকে আগামী নির্বাচন মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন ৬ জন নেতা। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কাজী মনিরুজ্জামান। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া (দিপু), জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক নাসির উদ্দিন, জেলা কমিটির অন্যতম যুগ্ম আহবায়ক ও দাউদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শরিফ আহমেদ টুটুল, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক মো. দুলাল হোসেন এবং রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাহফুজুর রহমান হুমায়ুন। অপরদিকে সারা দেশের মতো রূপগঞ্জেও জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন আনোয়ার হোসেন মোল্লা। তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দলীয় প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের অগণিত হামলা এবং দুই
শতাধিক মামলা মোকাবিলা করেছি। রূপগঞ্জে বিএনপির হারানো গৌরব এবং দলের ভাবমূর্তি ফিরাতে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি বিএনপির ঘাঁটি রূপগঞ্জের মানুষ ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দিয়ে বিএনপি প্রার্থীকে বিজয়ী করবে। রূপগঞ্জ থেকে ভূমিদস্যুতা রোধ ও শিল্পায়নের স্বপ্ন বুনছি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আহবায়ক কমিটির ১ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু বলেন, ‘নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের হামলা-মামলা প্রতিরোধে সামনের সারিতে ছিলাম। রূপগঞ্জে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে দলীয় কর্মসূচিতে নিয়মিতভাবে যোগ দিচ্ছেন। আশা করি দল আমাকে মনোনয়ন দিয়ে মূল্যায়ন করবে। কারন দলের দূর্দিনে দল গুছিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও রূপগঞ্জ আসনে নেতা কর্মীদের খোঁজ রাখাসহ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পালন করেছি।
বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি দুলাল হোসেন বলেন, বিগত সাড়ে ১৬ বছর দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের হায়েনাদের হামলা,মামলাসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। কারাবরণ, কারা নির্যাতন পরবর্তী হাসপাতালে ডান্ডাবেরীসহ চিকিৎসার নামে নির্যাতন, বাড়ি ঘরে হামলা,লুটপাটের শিকার হয়েছি। কিন্তু দলের প্রতিটি নির্দেশনা রাজপথে থেকে পালন করেছি। সবশেষে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে হাসিনা তাড়ানোর আন্দোলনে, ছাত্র জনতার জুলাই বিপ্লব ঘটাতে জীবন বাজি রেখে সক্রিয় ছিলাম। আমি দলের মনোনয়ন পেতে অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশিদের তুলনায় বেশি নির্যাতিত, দলের প্রতি নিবেদিত। তাই দল আমাকে মনোনয়ন দিয়ে মূল্যায়ন করলে আমি রূপগঞ্জকে ৩১ দফার আদলে জনগণের মনজয়,রূপগঞ্জের উন্নয়ন করতে চাই।
বিএনপির জেলা আহবায়ক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও দাউদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শরিফ আহমেদ টুটুল বলেন, ‘ক্লিন ইমেজ’ প্রার্থী হিসেবে দল যদি মনোনয়ন দেয় তবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে রূপগঞ্জের আসনটি পুনরুদ্ধার করে বিএনপির শক্তিকে আরো মজবুত করতে চাই।’আমার দীর্ঘ সময় ধরে জনগণের সেবা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। জনগণের মন বুঝার ক্ষমতা রয়েছে। তাই আমি এ আসনটিকে অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দেব।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক নাসির উদ্দিন বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট দ্বারা নির্যাতিত হয়েও দলের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।রূপগঞ্জ আমার আপন ঠিকানা। দল আমাকে সুযোগ দিলে রূপগঞ্জকে আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন সমৃদ্ধ করতে চাই। বেকারত্ব গোঁছাতে শিল্পকারখানায়,চাকুরী, ভূমিদস্যূতা রোধে কাজ করতে চাই।
রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান হুমায়ূন বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিলাম। রূপগঞ্জের মানুষের পাশে থেকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিএনপিকে সুসংগঠিত করেছি। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সন্ত্রাস, মাদকমুক্ত ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রূপগঞ্জ উপহার দিব।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী ও রূপগঞ্জ উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী মানুষকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। জনগণ আগামী নির্বাচনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে, উপজেলাকে চাঁদাবাজ, দুর্নীতি, মাদক এবং ভূমিদস্যু মুক্ত রূপগঞ্জ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’ ইসলামী রীতি অনুযায়ী ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চাই।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (ইশা)র মনোনীত প্রার্থী মুফতি ইমদাদ উল্লাহ হাশেমী বলেন, রূপগঞ্জের মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা, এখানকার মানুষের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে নিরাপত্তা দান, ইসলামী শাসনের সুফল পরিবেশ বাস্তবায়ন হবে আমার প্রথম কাজ। তবে অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাবমুক্ত।
জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, জাতীয় পার্টি আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে অংশ নিবে কীনা বা কোন জোট গঠন করবে কি না তা সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাপা যদি নির্দেশ দেয় আমি নির্বাচন করবো। তবে রূপগঞ্জ উপজেলার সাধারণ জনগণের সুশাসন ও নিরাপত্তা রক্ষায় , নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা থাকা দরকার। রূপগঞ্জবাসি যেন অতীতের মতো গাজী টাইপের শাসকের খপ্পরে না পড়েন, তাই এখানকার ভোটারদের সজাগ ও সচেতন হতে হবে।
স্থানীয় ভোটারদের দাবী, নারায়ণগঞ্জ ১ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকায় ৬ নেতার মনোনয়ন দৌড় লক্ষণীয়। তাই সঠিক প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হলে আসনটি চলে যেতে পারে অন্যদলের হাতে। বিএনপির একটি অংশ মনে করেন প্রয়াত আব্দুল মতিন চৌধুরী ছিলেন রূপগঞ্জ বিএনপির প্রাণ পুরুষ। তিনি ৭৯ সাল থেকে একাধিকবার এই আসনে এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী ছিলেন। পূর্বাচল উপশহর গড়ে তোলাসহ আধুনিক রূপগঞ্জের অন্যতম রূপকার তিনি। তার অবর্তমানে স্থানীয় বিএনপিতে তার পরিবার ও অনুসারীদের বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। আগামীতে বিএনপি থেকে যিনিই এ আসে মনোনয়ন পান না কেন তাকে বিজয়ী হতে হলে ঐ ভোট ব্যাংকের ভোট নিজের পক্ষে আনতে হবে। তাহলেই বিএনপি প্রার্থী জয়ী হতে পারে। অন্যথায় বিএনপির ৬টি বলয়ে বিভক্তির সুযোগ নিতে পারেন জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলের একক প্রার্থীরা।
রূপগঞ্জ আসনে এনসিপির হয়ে রোমান নামীয় এক ছাত্রনেতা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতা ইফতেখার ভুইয়া রিদ্বীন। তিনি বলেন, এনসিপি মাঠে করছে। সময় হলে ভোটের মাঠেও লড়বে।
সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ ১ আসনের আংশিক ভেঙে আরও একটি আসন করতে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনে প্রক্রিয়া চলমান। সে হিসেবে বর্তমানে যারা দৌড় ঝাপ করছেন আসন ভাগাভাগি হলে প্রার্থীতায় পরিবর্তন এবং নতুন মুখ পেতে পারে আসনটিতে। তবে রূপগঞ্জের মূল সমস্যা ভূমিদস্যুতা প্রতিরোধে যে প্রার্থী নিজের সক্ষমতা দেখাবে নিরপেক্ষ ও অবাধ,সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ওই প্রার্থীই জয়ী হবে বলে মনে করেন এখানকার সচেতন মহল।